উত্তরা ব্যাংকের এমডির বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ: শাস্তির দাবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের

বিশেষ প্রতিনিধি:

 

দেশের অন্যতম প্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংক উত্তরা ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অভিযোগ রয়েছে, তিনি একনায়কতন্ত্র কায়েম করে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, এমডির একক কর্তৃত্বের কারণে ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম), এক্সিকিউটিভ জেনারেল ম্যানেজার (ইজিএম) ও ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি)-দের মতো শীর্ষ কর্মকর্তারাও তাদের পাওয়ার যথাযথভাবে এক্সারসাইজ করতে পারছেন না। ফলে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাজের গতি থমকে গেছে, প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এমডির একক ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে চিকিৎসা ব্যয় বাবদ এমডি ব্যাংক থেকে ২৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৩ টাকা নিয়েছেন, যা অস্বাভাবিক। এ ছাড়া বাসার গার্ড, কুক ও অন্যান্য খরচের জন্য ব্যাংকের তহবিল থেকে নেওয়া ২৬৩,৫৩৮ টাকা এবং লিভ ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স বাবদ ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এমডির দুর্নীতির প্রমাণ মিললে তাঁকে ৩৪ লাখ টাকা জরিমানা গুণতে হয়। এমনকি একাধিক গণমাধ্যমে “অবৈধ বোনাসে জরিমানা গুণলেন উত্তরা ব্যাংকের এমডি” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এমডি তার ভাই আনোয়ার হোসেনকে উত্তরা শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার থাকার সময় ২১ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করান। পরবর্তীতে সেই টাকা ব্যাড লোনে পরিণত হয়। অথচ এমডির ভাই কোনো শাস্তির বদলে পদোন্নতি পেয়ে ডিজিএম এবং পরে জোনাল হেড পদে নিযুক্ত হন। অন্যদিকে, একই ধরনের অনিয়মে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।

এছাড়া, এমডি পদোন্নতির ক্ষেত্রে তার নিজ জেলা এবং আরেকটি প্রিয় জেলার কর্মকর্তাদের বেশি সুবিধা দিয়েছেন। তার আমলে ১০-১২ বছরেও অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি পাননি, যেখানে পূর্ববর্তী সময়ে ৩-৪ বছরের মাথায় সবাই পদোন্নতি পেতেন।

ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, এমডি প্রায়ই তাঁদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন এবং নোংরা ভাষা ব্যবহার করেন। এমনকি কনফারেন্স ও নিয়মিত আলোচনায় তিনি ‘চোর, বদমায়েশ, গুন্ডা, সন্ত্রাসী’ ইত্যাদি অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করেন। সিনিয়র কর্মকর্তাদের জুনিয়রদের অধীনে বদলি করা, দূর-দূরান্তে বদলি করে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা এবং এলপিআর সুবিধা না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এমডি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ীদের এলসি খোলার অনুমতি দিচ্ছেন না, বরং চড়া দামে অন্য ব্যাংকে ডলার বিক্রি করে অনৈতিকভাবে মুনাফা করছেন।

ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একত্রিত হয়ে এমডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, এমডির মেয়াদ তৃতীয়বারের মতো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি, তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে এমডির বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, যা আদালতে গড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গণহত্যার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই মামলার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন। উত্তরা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন মহল থেকে তার উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে।

এছাড়া, আশুলিয়ার একটি হত্যা মামলায় তার বিরুদ্ধে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। মামলাটির নম্বর ২৫/২০২৪। তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে এমডি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ভিজিট ভিসায় যান। এরপর তিনি চোখের অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নেন। গত সপ্তাহে তিনি দুই মাসের ছুটি বর্ধিত করার জন্য বোর্ডের কাছে আবেদন করেন। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি মামলার ভয়-ভীতির কারণে দেশে ফিরছেন না এবং পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রশ্ন উঠছে, একজন হত্যা মামলার আসামি হয়ে কীভাবে এখনো ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বহাল থাকতে পারেন?

ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও সুনাম রক্ষায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা আশা করছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বেচ্ছাচারী প্রশাসকের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ব্যাংক তার সুনাম পুনরুদ্ধার করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *