মোহাম্মদ হোসেন সুমন:
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী জনপদ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ বর্তমানে মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম নাম। রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১৩-১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় প্রায় ৩ লক্ষ বাসিন্দা মিলে ১৬-১৭ লক্ষ মানুষের চাপ সামলাচ্ছে এই ছোট্ট ভূখণ্ড। ফলে জনজীবনের প্রতিটি খাতে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় নেমে এসেছে নজিরবিহীন সংকট।
সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো এ বিপুল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার ভার বহনে কার্যত অক্ষম হয়ে পড়েছে। ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, চর্মরোগ, নিউমোনিয়া, জন্ডিস, শ্বাসকষ্ট, মানসিক অবসাদসহ নানা রোগ প্রতিদিন বাড়ছে। রোগীর চাপ বাড়লেও চিকিৎসা, ওষুধ ও অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়েনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে ৪ জনই কোনো না কোনো রোগে ভুগছেন। ক্যাম্পগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানির অভাবই এর মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উপজেলা স্বাস্থ্যসেবার ভাঙা হাল
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিদিন ৪০০-৫০০ রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে চরম বিপর্যস্ত। অথচ সেখানে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। নেই পর্যাপ্ত ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি সেবা কিংবা ল্যাব সুবিধা। ফলে রোগীরা বাধ্য হচ্ছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতাল বা চট্টগ্রামে ছুটে যেতে, যেখানে পৌঁছাতেই সময় লাগে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা—অনেক সময় এই বিলম্বেই রোগীর প্রাণ হারায়।
জনপ্রতিনিধি ও পেশাজীবীদের ক্ষোভ
দৈনিক কক্সবাজার একাত্তরের নির্বাহী সম্পাদক স.ম. ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট আমাদের ওপর মানবিক দায়িত্ব চাপিয়েছে ঠিকই, তবে নিজের জনগণকে অবহেলিত করা চলবে না। এখনই সময় একটি আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনের।”
পরিবেশবাদী নেতা আমিনুল হক জানান, “পরিবেশ যেমন হুমকির মুখে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের অবস্থাও ভয়াবহ। একটি আধুনিক হাসপাতাল ছাড়া এই দুর্দশা লাঘব সম্ভব নয়।”
উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সাজেদুল ইমরান শাওন বলেন, “আমরা প্রতিদিন ৮-১০ গুণ বেশি রোগী সামলাতে বাধ্য হচ্ছি। রোগীরা বিছানাই পায় না, চিকিৎসা তো অনেক দূরের কথা।”
সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহিন আক্তার বলেন, “নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। প্রসূতিদের জীবন হুমকির মুখে।”
ছাত্রনেতা মো. জাহেদুল আলম জাহেদ জানান, “চিকিৎসার জন্য রাত পার করার কষ্ট আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তরুণ সমাজ সচেতন, কিন্তু অসহায়।”
সাহিত্যকর্মী সিরাজুল কবির বুল বুল বলেন, “চিকিৎসা শুধু সেবা নয়, এটি একধরনের সম্মান। আমরা সেই সম্মান হারাচ্ছি।”
সংস্কৃতিকর্মী এ আর হারুন বলেন, “জীবন আগে, সংস্কৃতি পরে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়া জীবন রক্ষা সম্ভব নয়।”
শিক্ষক মাস্টার আবুল কালাম আজাদ বলেন, “একটি হাসপাতাল শুধু রোগী নয়, পুরো সমাজকে সুস্থ রাখে। শিক্ষার্থীরাও নিরাপদে বেড়ে ওঠে।”
সমাধানের দাবি: বাংলা-চায়না আধুনিক হাসপাতাল
সব পক্ষের অভিন্ন দাবি—এত বড় জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যসংকট মোকাবেলায় উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে একটি আধুনিক ‘বাংলা-চায়না হাসপাতাল’ স্থাপন করা হোক। একটি পূর্ণাঙ্গ, ২০০-৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন করলে কক্সবাজার দক্ষিণাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।
এটি শুধু একটি হাসপাতাল নয়, হতে পারে মানবিক নবজাগরণের সূচনা—যেখানে মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না, বাঁচবে।