মো. আরাফাত হোসেন:
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃত্যশিল্পী এবং একইসাথে ব্রিটিশ ও বাংলাদেশি নাগরিক মোহাম্মদ দ্বীপ মনে করেন, আজকের দ্রুতগতির ও প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনে সুস্থ শরীর ও প্রশান্ত মন লাভের অন্যতম উপায় শাস্ত্রীয় নৃত্য। শাস্ত্রীয়, রবীন্দ্র, সাধারণ ও লোকনৃত্যে সুপরিচিত এই নৃত্যশিল্পী সম্প্রতি লন্ডন থেকে মুঠোফোনে এক সাক্ষাৎকারে তরুণ প্রজন্মের কাছে শাস্ত্রীয় নৃত্যের অপরিসীম গুরুত্ব তুলে ধরেন।
মোহাম্মদ দ্বীপ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “শুধু ঐতিহ্য রক্ষাই নয়, সুস্থ জীবন এবং গভীর মানসিক শান্তির অনুসন্ধানেও আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা অত্যন্ত জরুরি।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে যখন যুব সমাজ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, তখন ভরতনাট্যম, কত্থক, ওডিশি বা মণিপুরীর মতো চিরায়ত নৃত্যশৈলীগুলি তাদের শেকড়ের সঙ্গে এক মজবুত সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এই নৃত্যগুলির প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি তাল যেন আমাদের ইতিহাস, দর্শন এবং জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি, যা তরুণদের আত্মপরিচয়কে আরও দৃঢ় করে তোলে।
বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা) থেকে অর্জিত কত্থক নৃত্যের দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ তাঁর শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শাস্ত্রীয় নৃত্যের এই বিশেষ ধারায় নিবিড় পরিচর্যা তাঁর দক্ষতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শাস্ত্রীয় নৃত্যের শারীরিক উপকারিতার কথা উল্লেখ করে মোহাম্মদ দ্বীপ বলেন, “নিয়মিত শাস্ত্রীয় নৃত্যের অনুশীলন শরীরের নমনীয়তা বৃদ্ধি করে, পেশীগুলিকে শক্তিশালী করে এবং শারীরিক ভারসাম্য উন্নত করে। এটি কেবল একটি চমৎকার ব্যায়ামই নয়, বরং মানসিক চাপ কমাতেও এর জুড়ি মেলা ভার।” তিনি আরও যোগ করেন, “আজকের তরুণ প্রজন্ম যেভাবে মোবাইল ফোন ও ভার্চুয়াল জগতের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে, তাতে শারীরিক ও মানসিক স্থবিরতা বাড়ছে। শাস্ত্রীয় নৃত্যের মতো প্রাণবন্ত একটি শিল্প মাধ্যম তাদেরকে এই আসক্তি থেকে মুক্তি দিতে এবং একটি সক্রিয় ও সুস্থ জীবনধারা বেছে নিতে উৎসাহিত করতে পারে।” তবে, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করেন মোহাম্মদ দ্বীপ। তিনি মনে করেন, এর জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবনী প্রচার এবং আকর্ষণীয় উপস্থাপনা। “আমাদের এমন একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তরুণরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখতে আগ্রহী হবে। স্কুল, কলেজ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কর্মশালা ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার আয়োজন করা যেতে পারে।”
নদী মিউজিক এন্ড ডান্স মিডিয়া ইউকে এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দ্বীপ যুক্তরাজ্যে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রবাসে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মও তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আগ্রহ পোষণ করে। “আমি দেখেছি, যখন তাদেরকে সঠিকভাবে আমাদের শিল্পের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য বোঝানো যায়, তখন তারা অত্যন্ত উৎসাহ দেখায়।” তরুণ প্রজন্মের অভিভাবকদের প্রতি মোহাম্মদ দ্বীপের আন্তরিক আহ্বান, “আপনার সন্তানদের শুধুমাত্র একটি শখ হিসেবে নয়, বরং একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পথে চালিত করার হাতিয়ার হিসেবে শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখতে উৎসাহিত করুন। এটি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এক অমূল্য অবদান রাখবে।” শিল্প ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি সম্প্রতি সিটি প্রেস ক্লাব সাংবাদিক কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরের সিটি প্রেস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ অর্জন করেন। সিটি প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. রাশেদুল ইসলাম মোহাম্মদ দ্বীপের শিল্প ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “শাস্ত্রীয় নৃত্যকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা এবং এর প্রসারে তাঁর উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই স্বীকৃতি তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মে আরও উৎসাহ যোগাবে।
মোহাম্মদ দ্বীপ দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তরিক আগ্রহের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় নৃত্য খুব শীঘ্রই তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে একটি স্থায়ী স্থান করে নেবে এবং আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিশ্ব মঞ্চে আরও গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হবে।