স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক নানা কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। তবে ভোট আয়োজনের জন্য অপরিহার্য বেশ কিছু নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ইসি প্রধানত রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ গঠনের জন্য অপেক্ষা করছে। এই অবস্থায় নির্বাচন সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা ও অন্যান্য নীতিমালা সংশোধনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
নির্বাচনের প্রধান আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন, নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধনের মতো বিষয়গুলো এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। এছাড়া ভোটার তালিকা সংশোধন, নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ চলছে, তবে এসবের অনেককটিই এখনো সমাপ্ত হয়নি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংশোধনী খসড়া তৈরি চলছে যাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত পাওয়া মাত্রই দ্রুত কাজ শেষ করা যায়। নির্বাচন কমিশনাররা আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী জুন-জুলাই মাসের মধ্যে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।
সরকার ও ইসির মধ্যে আলোচনা হয়েছে যে, ভোট যদি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তার সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। তবে এপ্রিলে ভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে রমজান মাসের সঙ্গে সময়সূচি মেলানো কঠিন হওয়ায় এবং এসএসসি পরীক্ষাসহ অন্যান্য জরুরি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এপ্রিলে ভোট করা কঠিন বলে মনে করছে সরকার ও ইসি।
এছাড়া, নির্বাচন কমিশন চায় না এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক যা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই ‘জাতীয় সনদ’ হিসেবে পরিচিত ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের জন্য অপেক্ষা করছে ইসি, যা রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত মতামতের প্রতিফলন হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আশা করছে, জুলাই মাসের মধ্যে এই সনদটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে, নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো কিছুটা এগিয়ে গেলেও এগুলোর অনেকটাই এখনো অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ইসি ভোটের প্রস্তুতিতে নানা প্রক্রিয়া চালু করেছে, তবে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে।
দেশীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের জন্য তিনটি সংশোধিত নীতিমালা অনুমোদনের পরও তা কার্যকর হয়নি। এই নীতিমালা কার্যকর হলে নিবন্ধিত ৯৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন বাতিল হয়ে নতুন করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হবে, কিন্তু এখনও তা শুরু হয়নি। নতুন নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগতে পারে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। চলতি বছরের ২৬ মে পর্যন্ত প্রায় ৬৫ লাখ নতুন ভোটারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ২১ লাখ মৃত ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ভোটার তালিকা আইনের সংশোধনী এখনও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। এই সংশোধনী ছাড়া বছরের যেকোনো সময়ে তালিকা হালনাগাদ সম্ভব নয়, যা নির্বাচনে নতুন ভোটারদের অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পরিকল্পনা তৈরি হলেও তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। গত নির্বাচনের তুলনায় এবার প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় চার মাস সময় প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছে ইসি।
রাজনৈতিক দল, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, পর্যবেক্ষক সংস্থা, সাংবাদিক ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপের তারিখও এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে সংলাপ পিছিয়ে গেছে।
নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের চলমান বৈঠককে গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকেও ইসির নজর রয়েছে।
এভাবে নির্বাচন ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে কাজ চালু থাকলেও রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে। তাদের মতে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে তা জাতীয় সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে, যার ফলে পুনরায় কাজ করতে হতে পারে এবং নির্বাচন পরিচালনার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
সুতরাং, নির্বাচন কমিশনের জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং নির্বাচন ব্যবস্থার সংশোধনী দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এই দিকেই নজর রাখছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন।