বিআরটিএতে ইয়াছিনের নেতৃত্বে সুসংগঠিত আওয়ামী লীগের আমলারা, মাঠের দায়িত্বে শীতাংশু ও সুব্রত

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন তার মেয়াদকালে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস ও উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) সুব্রত কুমার দেবনাথকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী গ্রুপ, যারা বিআরটিএ’র প্রকল্প বণ্টন, প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন এবং পদায়ন প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেন।

ভারতের প্রভাব ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা

অভিযোগ রয়েছে, ভারতপ্রীতি ও রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে এই কর্মকর্তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে ভাড়ার তালিকায় “বঙ্গবন্ধু সেতু” ও “বঙ্গবন্ধু টানেল” নাম বহাল রাখার মাধ্যমে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। এই আদেশ অমান্য করে শীতাংশু শেখর বিশ্বাস ও সুব্রত দেবনাথ স্বাক্ষরিত তালিকা প্রকাশিত হলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

দলীয় সংশ্লিষ্টতা ও সুবিধাভোগ

সুব্রত দেবনাথের ভাই পংকজ দেবনাথ ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও পরিবহন খাতে প্রভাবশালী ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পংকজ দেশ ছেড়ে পালান এবং সুব্রত দেবনাথের অবস্থান বিআরটিএতে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায়ও তিনি প্রভাব বিস্তার চালিয়ে যান। এমনকি তিনি ঢাকা মেট্রো-১ সার্কেলের উপপরিচালক হওয়ার জন্য ভারতের হাই কমিশনারের মাধ্যমে সুপারিশ করেছেন বলেও প্যাসেঞ্জার ভয়েসের সূত্র জানিয়েছে।

সিএনএস-কে বারবার কার্যাদেশ, শীতাংশুর একচেটিয়া প্রভাব

বিআরটিএ’র ডিজিটাল প্রকল্পগুলো যেমন ফিটনেস ইন্সপেকশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, সার্ভিস পোর্টাল ইত্যাদির কার্যাদেশ দীর্ঘদিন ধরে একক প্রতিষ্ঠান সিএনএস (কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস) লিমিটেডকে প্রদান করা হয়েছে।

প্রায় সবগুলো দরপত্র ও মূল্যায়ন কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন শীতাংশু শেখর বিশ্বাস। এতে বিআরটিএ একপ্রকার ওই একটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে এই কাজগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আনিসুল হকের সুপারিশ ও মো. ইয়াছিনের ভূমিকা

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সুপারিশে মো. ইয়াছিন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তার নিয়োগের পর আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠিত করে প্রশাসনের দখল নেন। শীতাংশু শেখর বিশ্বাসকে পরিচালক (অপারেশন) থেকে বদলি করে আবার প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক করা হয় এবং মীর আহমেদ তারিকুল ওমরকে নিয়ম ভেঙে অপারেশন উইংয়ের পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। এতে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থায় বিতর্ক তৈরি হয়।

ভাড়ার তালিকায় অনিয়ম

২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত আন্তঃজেলা ভাড়ার তালিকায় দেখা যায়, নতুনভাবে নির্ধারিত হয় কিলোমিটার প্রতি ২.১২ টাকা ভাড়া এবং বিভিন্ন সেতুর টোল (যেমন ৩০৩ ও ৩০৫ নম্বর রুটে ৩৫.৫০ টাকা)। কিন্তু এই তালিকায় সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নাম পরিবর্তন না করে পুরোনো নাম বহাল রাখা হয়।

দক্ষ কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ ইমরানের বদলি

ঢাকা মেট্রো-১ সার্কেলের ফিটনেস শাখায় বদলি করা হয়েছে নরসিংদী সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) শেখ মোহাম্মদ ইমরানকে। দীর্ঘদিন ধরে মোটরযান ফিটনেস বিষয়ে অভিজ্ঞ এই কর্মকর্তার বদলিকে ঘিরে ভেতরে-বাইরে নানান আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, তিনি দায়িত্ব পেলে ভিআইসি-তে চলমান অনিয়ম বন্ধ হতে পারে।

উপসংহার

বিআরটিএ বর্তমানে এক সংকটময় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রকল্পে স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়মের ফলে এর স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদের সামনে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিআরটিএকে জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *