স্টাফ রিপোর্টার:
মানুষের লোভ ও অবহেলায় হারিয়ে যাওয়া নৌপথ পুনরুদ্ধারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরই অংশ হিসেবে সফলভাবে ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে কংস ও ভোগাই কংস নদীর। এতে করে সচল হয়েছে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথ।
ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এই দুটি নদীর খনন শেষে পরিবর্তন এসেছে দুই পাড়ের জনজীবনে। নদী ফিরে পেয়েছে নাব্যতা, চারপাশে ফিরেছে প্রাণ। ২০২২ সালে ড্রেজিং কাজ শেষ হলেও এর সুফল এখন দৃশ্যমান। নদীপাড়ের অন্তত ৫৫টি হাট-বাজার আবারও সচল হয়েছে।
খননকৃত মাটি ব্যবহার করে ডোবা ও নিচু জায়গা ভরাট করে ২০২ বিঘা জমি চাষের আওতায় আনা হয়েছে। আগে যেখানে শুকনো মৌসুমে নদী শুষ্ক হয়ে যেত, এখন সেখানে সারা বছর পানি থাকে। ফলে বেড়েছে সেচব্যবস্থা, বাড়ছে ফসলের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য।
‘৫৩টি নৌপথ ক্যাপিটাল ড্রেজিং (১ম পর্যায়: ২৪টি নৌপথ)’ প্রকল্পের আওতায় কংস ও ভোগাই কংস নদীর জন্য বরাদ্দ ছিল ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের পাঁচটি প্যাকেজে ৭২.৯৭ লাখ ঘনমিটার মাটি ড্রেজিংয়ের খরচ হয়েছে ১১২ কোটি টাকার কিছু বেশি।
এ কাজ বাস্তবায়ন করেছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ৯টি ড্রেজার, যাদের টানা তিন বছরের পরিশ্রমে সম্পন্ন হয় প্রকল্পটি। এতে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মতামতে উঠে এসেছে।
ড্রেজিংয়ের কারণে সারা বছর নদীতে পানির প্রবাহ থাকায় মাছের প্রাচুর্য বেড়েছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক জলজ প্রাণী ফিরে এসেছে। নদীর গভীরতা বাড়ায় বন্যার সময় পানি দ্রুত নেমে যায়, কমে আসে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি।
খননকৃত পলি ব্যবহার করে ফুলপুর খেলার মাঠ, জৈনপুর ও দোবাইলের হাওর বাঁধসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। ধর্মপাশা থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার এলাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ও মালবাহী ট্রলার চলাচল শুরু হয়েছে।
নদীভিত্তিক জীবিকায় ফিরেছেন অনেকেই। জমির মূল্য বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। ড্রেজিং করা মাটি দিয়ে প্রায় ৫০০টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিচু জমি ভরাট করে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে।
গাগলাজোড় গ্রামের মো. মুজিবর রহমান বলেন, “ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে নিচু জমি ভরাট করে কৃষি চাষ সম্ভব হয়েছে। অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হচ্ছে।” ধর্মপাশার ফজলুর রহমান বলেন, “নদী মৃত ছিল, এখন আবার বেঁচে উঠেছে।” কচুয়ারচরের আওলাদ হোসেন জানান, “চৈত্র মাসেও নদীতে এখন পানি থাকে, পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করছে।” পূর্বধলার এখলাস উদ্দিন বলেন, “আগে নদী শুকিয়ে যেত, আমি বেকার হয়ে পড়তাম। এখন নদীতে পানি থাকায় খেয়ার কদর বেড়েছে।”
ড্রেজিংয়ের আগে ও পরে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা করেছে সিইজিআইএস। জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে আট সদস্যবিশিষ্ট কমিটির নির্দেশনায় ড্রেজিং মাটির ব্যবস্থাপনা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) ও প্রকল্প পরিচালক মো. ছাইদুর রহমান বলেন, “আমরা কোনো আপস করিনি। প্রায় ১৪০ কিমি নদীতে পানিপ্রবাহ ফিরেছে।”
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মতামতে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিএ’র কার্যক্রম পরিচালিত হয় সদস্য, চেয়ারম্যান এবং বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে। এককভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ নেই।
প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “ভালো কাজের পেছনে সংকট আসবে, কিন্তু থেমে গেলে চলবে না।”
নদী ও জনজীবনের এই পরিবর্তন প্রমাণ করে, যথাযথ পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা থাকলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কেবল খরচ নয়, দেশের জন্য লাভের খাত তৈরি করতে পারে।