স্বাধীন সংবাদ ডেস্ক:
খুন, গুম, নির্যাতনে আজ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত এক বাংলাদেশ। স্বৈরাচারের শাসনে দাবিয়ে রাখা হয়েছে শত শত প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। হাজারো মানুষ বন্দি কারাগারে, বাড়ছে গোপন বন্দিশালা—আয়নাঘর। দুর্নীতি ও লুটপাট যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। একের পর এক ধসে পড়ছে ব্যাংক ব্যবস্থা। তার পরও চারদিকে চলছে ফ্যাসিবাদী বন্দনা, সাধুবেশে শয়তানদের উল্লাস। দেশের গণতন্ত্র আজ করায়ত্ত—‘আপা’ থাকছেন, তিনিই সব!
দিনের ভোট রাতে হয়ে যায়, ডামি ভোটের উৎসবেই একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে জনগণ। ভোটের মাঠে আর নেই সেই তারুণ্যের পদচারণা, নেই বিশ্বাস। একটি প্রজন্ম ছিটকে পড়েছে ভোটের রাজনীতি থেকে।
এভাবেই একের পর এক বছর গড়ায়। শোষণের শৃঙ্খল ভাঙে না। ষোলো বছরের ক্ষোভ, কান্না আর আর্তনাদের শেষে যেন আকাশ-বাতাসে গর্জে ওঠে মানুষের মুক্তির আহ্বান। ঠিক তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী। আত্মত্যাগের শপথে এবার বিপ্লবীরা প্রস্তুত জীবন দিতে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—জেগে ওঠে অন্য এক বাংলাদেশ।
রক্তাক্ত জুলাইয়ে শহীদদের আত্মদানে নতুন ইতিহাসের পাতা রচিত হয়। ফররুখ আহমেদের পাঞ্জেরি কবিতার “গভীর রাত” যেন ছুটে চলে ভোরের দিকে। শহীদের হাসিমুখের লাশ ছুটে যায় মর্গে, আর প্রতিটি মৃত্যু হয়ে ওঠে চেতনার বাতিঘর।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-‘আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ভয়াল কালবৈশাখীর উন্মাতাল গতির প্রতাপ বক্ষে ধারণ করে-দিক থেকে দিগন্তে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে লক্ষকোটি বজ্রের গর্জন;
বলরে বন্য হিংস্র বীর,
দুঃশাসনের চাই রুধির!
ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই,
দুঃশাসনের রক্ত চাই!’
এই চেতনাকে ধারণ করে বিপ্লবীরা ছিনিয়ে আনে বিজয়। ছত্রিশে জুলাইয়ের প্রভাতে উদিত হয় রক্ত লাল সূর্য, শুরু হয় নতুন দিনের অঙ্গীকার।
৫ আগস্ট: পতনের ইতিহাস
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের দিন। লাখ লাখ মানুষ যখন গণভবনের পথে, তখন স্বৈরাচার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সদলবলে দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে, হেলিকপ্টারযোগে। পরে সেনাপ্রধান টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন।
গণভবন, সংসদ ভবন, এমনকি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরেও পৌঁছে যায় জনতার ঢল। এভাবেই কোটি মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আরেকটি স্বাধীনতা।
গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা
৫ জুন ২০২৪: সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রায় দিলে প্রতিবাদ শুরু হয়।
৬ জুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিক্ষোভ।
৯ জুন: আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও।
৩০ জুন: সরকারকে সময়সীমা দেয় আন্দোলনকারীরা।
রক্তাক্ত জুলাইয়ের সময়রেখা
-
১–৪ জুলাই: ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ।
-
৪ জুলাই: শাহবাগ অবরোধ, ধর্মঘটের ডাক।
-
৬–৭ জুলাই: ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি।
-
৮ জুলাই: ৬৫ সদস্যের সমন্বয় টিম গঠন।
-
১০ জুলাই: আদালতের স্থিতাবস্থা রায়।
-
১১–১২ জুলাই: ছাত্রলীগের হুমকি ও সংঘর্ষ।
-
১৪ জুলাই: শেখ হাসিনার বক্তব্যে বিস্ফোরণ—‘আমার কিছু করার নেই’।
-
১৫ জুলাই: ওবায়দুল কাদের ও ছাত্রলীগ নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষ।
-
১৬ জুলাই: আবু সাঈদের মৃত্যুতে আন্দোলনে আগুন।
-
১৭–১৮ জুলাই: সংঘর্ষে ২৭ জন নিহত, মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ।
-
১৯ জুলাই: ৯ দফা দাবি পেশ, সরকার পতনের ডাক।
-
২০ জুলাই: দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন, ২৬ জন নিহত।
-
২১–২৩ জুলাই: সমন্বয়করা হেফাজতে, আন্দোলন অব্যাহত, কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি।
-
২৪–২৮ জুলাই: আরও সমন্বয়ক নিখোঁজ, পুলিশের হেফাজতে সংবাদ সম্মেলন, ডিবি অফিসে ‘জবানবন্দি’।
-
২৯–৩০ জুলাই: সরকার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করলেও আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
-
৩১ জুলাই: ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি।
-
১ আগস্ট: ডিবির হেফাজত থেকে মুক্তি পায় ছয় সমন্বয়ক।
-
২ আগস্ট: ‘দ্রোহযাত্রা’, গণমিছিল, শিল্পীদের প্রতিবাদ।
-
৩ আগস্ট: সরকারের পদত্যাগ দাবিতে একদফা আন্দোলন।
-
৪ আগস্ট: সহিংসতায় আরও ১১৪ জন শহীদ।
-
৫ আগস্ট: শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও সরকারের পতন।
চূড়ান্ত বলিদান ও জাতির জাগরণ
দেড় হাজারের বেশি মানুষ জীবন দিয়েছে। আহত হয়েছে ত্রিশ হাজারের বেশি। অন্ধ, পঙ্গু হয়ে গেছে বহু মানুষ। প্রথম খসড়া শহীদ তালিকায় ৮৫৮ জন শহীদের নাম রয়েছে, আহত ১১ হাজার ৫৫১।
এ ছিল এক অনন্য ইতিহাস, রক্তের অক্ষরে লেখা। ‘জুলাই বিপ্লব’ আজ শুধু স্মৃতি নয়, তা এক চেতনার নাম, এক অঙ্গীকারের নাম।