সাংবাদিক তুহিন হত্যার মাস্টারমাইন্ড মিজান ও গোলাপীর অন্ধকার জগৎ, গ্রেপ্তার ৭

কামরুল ইসলাম:

ভয়ংকর এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা কেটু মিজান। দিনে দিনে তিনি আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন। গ্রেপ্তারের পরও তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেমে থাকেনি। পুলিশের কড়া পাহারা ও পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় গতকাল শনিবার আদালতে নেওয়ার সময় মিজান সবার উদ্দেশে বলে ওঠেন, “আপনারা নাটক-সিনেমা-ছবি করেন, আমি করি রিয়েল।”

গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে গলা কেটে হত্যার পরও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। বরং গতকাল দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশের সদর দপ্তর থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও চোখ পাকিয়ে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের সিঁড়িঘাট মিলন বাজার এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে কেটু মিজান গাজীপুরে এসে গড়ে তোলেন এক অপরাধ সাম্রাজ্য। মেলান্দহ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে তাঁর পরিবার চলে যায় রংপুরে। পরবর্তীতে একই এলাকার মো. সুলাইমানের মেয়ে পারুল আক্তার গোলাপীকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে মিজান চলে আসেন গাজীপুরে। তাঁর গড়ে তোলা জগতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন স্ত্রী।

দুজনে মিলে গাজীপুর মহানগরের ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা মোড় এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করতেন এই ছিনতাইকারী চক্র। ব্যস্ততম এ মোড় দিয়ে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ যাতায়াত করে। গোলাপী প্রতারণার ফাঁদ পেতে (হানিট্র্যাপ) যুবকদের তাঁর কাছে এনে লুটে নিতেন সবকিছু।

কেটু মিজান ও গোলাপী গ্রুপের সদস্য ছিলেন সাংবাদিক তুহিন হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া—পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন (২৮), খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার ময়লাপোতা এলাকার হানিফের ছেলে আল আমিন (২১), কুমিল্লার হোমনা থানার আন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে শাহ জালাল (৩২), পাবনার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে ফয়সাল হাসান (২৩), শেরপুরের নকলা থানার চিতলিয়া গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সাব্বির সুমন (২৬) এবং ত্রিশালের শহীদুল ইসলাম। ইতোমধ্যে এই ৮ জনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধারায় ২৯টি মামলা রয়েছে। শুধু মিজানই ১৫টি মামলার আসামি বলে জানিয়েছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ।

গত বৃহস্পতিবার রাতে কেটু মিজান ও গোলাপীর প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন শেরপুরের বাদশা মিয়া নামের এক যুবক। যার শেষ পরিণতির শিকার হয়েছেন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিন। বাদশাকে কোপানোর দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে ভয়ংকর এ গ্রুপের রোষানলে পড়েন তুহিন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করে তারা। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রুপের প্রধান কেটু মিজান, তাঁর স্ত্রী গোলাপীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে মেট্রোপলিটন পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করেন র‍্যাব-১ এর সদস্যরা।

গতকাল শনিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান জানান, ঘটনার দিন বাদশা মিয়া স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলেন। বিষয়টি দেখে বাদশাকে হানিট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করেন গোলাপী। গোলাপীর সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে বাদশা মিয়া বিষয়টি বুঝতে পারেন—তাঁকে হানিট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপর তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং বাদশা মিয়া গোলাপীকে ঘুসি মারেন।

তিনি বলেন, গোলাপীকে ঘুসি মারার পরপরই আগে থেকে ওত পেতে থাকা তাঁর সহযোগী পাঁচ-ছয়জন এগিয়ে এসে চাপাতি দিয়ে বাদশা মিয়াকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করেন। তখন বাদশা মিয়া সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, আর এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। তাঁর ভিডিও ধারণ করার বিষয়টি দুর্বৃত্তরা দেখে ফেলে এবং বুঝে যায় যে এই ভিডিওর মাধ্যমে তাদের অপরাধ মানুষের কাছে প্রকাশ পেয়ে যাবে।

পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, আসামিরা সাংবাদিক তুহিনের ভিডিওটি কেড়ে নেওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ায় এবং তাঁকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে সাংবাদিক তুহিন একটি চা স্টলে আশ্রয় নিলে তাঁকে সেখান থেকে ধরে এনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরপরই আমরা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করি। ফুটেজ দেখে আমরা আটজনকে চিহ্নিত করেছি। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারার কারণে তুহিন হত্যায় ব্যর্থতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে নাজমুল করিম বলেন, সাংবাদিক হত্যার দায় আমরা এড়াতে পারি না। আমাদের ব্যর্থতা ও জনবল স্বল্পতা রয়েছে।

বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। এর একটি মামলার বাদী হয়েছেন নিহত সাংবাদিক তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম। অপর একটি মামলার বাদী তুহিন হত্যার আগে সংঘটিত আরেকটি হামলার ঘটনায় আহত বাদশা মিয়ার ভাই। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া সাতজনকেই আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড চাওয়া হলে দুই দিন করে মঞ্জুর করেন বিচারক।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় কিশোরগঞ্জ থেকে শহীদুল ইসলাম নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। র‍্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার আশরাফুল কবির জানিয়েছেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় র‍্যাবের একটি দল গতকাল দুপুরে হাওরের ইটনা বাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর করিমগঞ্জের বালিখলা ঘাটে র‍্যাব-১ এর সদস্যদের কাছে তাকে হস্তান্তর করলে গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায়।

সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি এবং সারাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। এ সময় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও যোগ দেন।

চট্টগ্রামের পটিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, কর্ণফুলী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পার্বত্য জেলা লামা, রামু, কক্সবাজার, টেকনাফ; ফরিদপুরের সদরপুর, মধুখালী ও বোয়ালমারী; কুমিল্লার দাউদকান্দি; সুনামগঞ্জ ও ধর্মপাশা; পটুয়াখালীর দুমকী; জয়পুরহাট; নরসিংদী; রাজবাড়ী; রাজশাহী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাগমারা; সাতক্ষীরার শ্যামনগর; নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ; কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী; মাদারীপুর; নড়াইল; নাটোরের গুরুদাসপুর; লালমনিরহাটের পাটগ্রাম; পিরোজপুর; রংপুর; ময়মনসিংহের ভালুকা; মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম নগরীতে এসব কর্মসূচি পালিত হয়।

এদিকে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। গতকাল এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের নৃশংস ঘটনা শুধু একজন সাংবাদিকের জীবনই কেড়ে নেয়নি, বরং সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *