বর্তমান রাজনীতি: ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রহসনের অস্ত্র

মোঃ মামুন হোসেন:

 

মানবসভ্যতার বিকাশে রাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম। রাজনীতি মূলত জনকল্যাণের হাতিয়ার, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যম এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিক কাঠামো।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজকের বাস্তবতায় রাজনীতি তার মৌলিক উদ্দেশ্য থেকে অনেকখানি বিচ্যুত হয়েছে। বর্তমান সময়ে রাজনীতি যেন কেবল ক্ষমতা দখলের প্রহসনে পরিণত হয়েছে, যেখানে জনগণের স্বার্থ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার কিংবা মানবিকতা প্রায়শই উপেক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে রাজনীতি আজ গণমানুষের আস্থা হারাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ এটিকে একটি “ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রহসনের অস্ত্র” হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য জনগণের সেবা নয়, বরং ক্ষমতার আসনে বসা এবং তা দীর্ঘদিন ধরে রাখা। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে নানা কৌশল—প্রভাব খাটানো, আর্থিক লেনদেন, কালো টাকা, গোপন আঁতাত, এমনকি সহিংসতা। নির্বাচন জনগণের মতামত প্রকাশের সুযোগ হলেও, তা অনেক সময় প্রহসনে পরিণত হয়। ভোট কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রতিপক্ষকে দমন—সবই যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে জনগণের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং গণতন্ত্র তার অর্থ হারাচ্ছে।

ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে দমন করাই প্রধান কৌশল। সমালোচনার সুযোগ না দিয়ে বিরোধী মতকে দমন করা হয় মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতার কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে। বিরোধী দলের কর্মসূচিকে ব্যর্থ করতে সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়, আবার শাসক দলের সমর্থনেই সংঘটিত হয় রাজনৈতিক সন্ত্রাস। এভাবে রাজনীতি আর জনসেবার মাধ্যম থাকে না, বরং তা রূপ নেয় প্রতিশোধপরায়ণ প্রহসনের অস্ত্রে।

রাজনীতি যখন কেবল ক্ষমতা দখল ও ভোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলো অগ্রাধিকার হারায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সুশাসন—এসব বিষয়ে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতা অনুপস্থিত থাকে। ফলে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। তারা মনে করে, রাজনীতি কেবল রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার একটি মাধ্যম। এভাবেই সমাজে নৈরাশ্য ছড়ায়, গণতন্ত্র দুর্বল হয় এবং সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমে যায়।

বর্তমান সময়ে মিডিয়া রাজনীতির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও প্রভাবিত করা হয় ক্ষমতাসীনদের সুবিধার্থে। পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণা, ভিন্নমত দমন, কিংবা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করা—এসবই আজ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির অংশ।

এর ফলে জনগণ প্রকৃত সত্য জানতে পারে না এবং বিভ্রান্ত হয়।শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ক্ষমতার খেলা চলছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে কোনো কোনো দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। শাসকগোষ্ঠীও কখনো বিদেশি সমর্থন পেতে জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। এতে দেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় এবং রাষ্ট্র হারায় তার সার্বভৌমত্বের পূর্ণ মর্যাদা। যদি রাজনীতি প্রকৃত অর্থে জনগণের কল্যাণে কাজ করত, তবে সমাজে শান্তি, ন্যায়, সমতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো। কিন্তু যখন রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রহসনে পরিণত হয়, তখন তা সমাজের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বিকল্প রাজনৈতিক সংস্কৃতি—যেখানে থাকবে সত্যনিষ্ঠা, নৈতিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জনসেবার মনোভাব। স্বচ্ছ নির্বাচন, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন এবং সুশাসনই পারে রাজনীতিকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে আনতে। রাজনীতি কোনো ব্যক্তিগত লোভ কিংবা ক্ষমতা ভোগের অস্ত্র নয়, বরং এটি হওয়া উচিত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সর্বোত্তম মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতি প্রায়শই ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রহসনে রূপ নিচ্ছে।

এ প্রহসনের ফলে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জাতি পিছিয়ে পড়ছে। তাই সময় এসেছে রাজনীতিকে সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণমুখী করার, যাতে তা আর প্রহসনের অস্ত্র না হয়ে মানবতার মুক্তি ও অগ্রগতির হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *