পল্লবী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জসিম-রাজিব উমেদার সিন্ডিকেট, ৬০ টাকার চাকরি থেকে কোটি টাকার সাম্রাজ্য

স্টাফ রিপোর্টার:

রাজধানীর তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পল্লবী জোনে বহু বছর ধরে চলছে দুর্নীতি, দালালি ও ঘুষের রাজত্ব। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছে কথিত ‘উমেদার সিন্ডিকেট’, যার মূল হোতা উমেদার জসিম। মাত্র ৬০ টাকা দৈনিক হাজিরার বেতন থেকে শুরু করে আজ তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

তার সঙ্গে আছেন আরেক উমেদার রাজিব, দু’জনে মিলে পুরো অফিসকে পরিণত করেছেন দুর্নীতির আখড়ায়। ওমেদার রাজিব কথায় কথায় ঘুষ নেন। ঘুষের টাকা দিয়ে তিনি রাজধানীতে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট গড়ে তুলেছেন। এ বিষয়ে রাজিব বলেন, “পরিশ্রম করলে টাকা আসবেই। মানুষের উপকার করলে মানুষও আমাকে টাকা দেয়। ওই টাকা দিয়ে বাড়ি ও গাড়ি করেছি।”

গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে দুর্নীতির সাম্রাজ্য

উমেদার জসিমের জীবনের শুরুটা ছিল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। গার্মেন্টসে কাজ করতেন, সংসার চলত টানাপোড়েনে। পরে এক আত্মীয়ের সহায়তায় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঝাড়ুদারের কাজ পান। তখন প্রতিদিন মাত্র ৬০ টাকা হাজিরা ছিল তার আয়। কিন্তু আজকের দিনে সেই জসিম রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি, জমিজমা ও বিদেশে ব্যবসার মালিক।

এলাকাবাসী ও অফিসকর্মীদের অভিযোগ— সাধারণ চাকরিজীবী থেকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট নেতায় রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে রয়েছে দলিল বাণিজ্য ও ঘুষের টাকা।

নামে-বেনামে কোটি টাকার সম্পদ

তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জসিমের রয়েছে—

  • মিরপুর শাহ আলীবাগ ৩৭/এ নম্বর বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট

  • মিরপুর গার্ডেনে শাশুড়ির নামে এক কোটি টাকার ফ্ল্যাট

  • সাভার মসূরীখোলা এলাকায় ১৫-২০ শতাংশ জমি

  • ময়মনসিংহ ভালুকায় গরুর খামার

  • সৌদি আরবে যৌথ ব্যবসা

  • দামি হাইয়েস মাইক্রোবাস ও নোয়া গাড়ি (ভাই গিয়াস উদ্দিনের নামে)

  • গ্রামে (শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জ) একাধিক জমি ও পাকা বাড়ি

এলাকাবাসীর মতে, এসব সম্পদের বাজারমূল্য কয়েক দশক কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ জসিমের অফিসিয়াল আয় এখনও দৈনিক মাত্র ৬০ টাকা হাজিরা।

প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক ছত্রছায়া

বিগত আওয়ামী লীগ সময়ে সাংবাদিকরা তার কাছে তথ্য চাইতে গেলে নিজেকে পরিচয় দিতেন টুঙ্গীপাড়ার বাসিন্দা বলে এবং আওয়ামী লীগের প্রভাব দেখাতেন ২০২৪ সালে এক সাংবাদিক তথ্য সংগ্রহের জন্য তার কাছে গেলে তাকে তিনি হুমকি দেন বলেন আমার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া আপনি কিছুই করতে পারবেন না পরবর্তীতে সেই সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় একটি সাধারন ডাইরি করেন নিজের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে।”

এমনকি এক সাংবাদিক তার ভয়ে মিরপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, তিনি নিয়মিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পৌঁছে দেন, যার ফলে তার সিন্ডিকেট অক্ষত থাকে।

জসিমের কাছে কোন গণমাধ্যম কর্মী  গেলেই তাকে তিনি বলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল প্রিন্ট মিডিয়া অনলাইন সহ শীর্ষ গণমাধ্যম ব্যক্তিরা তাকে চিনে এবং তার সম্পর্কে জানে তাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক আর জসিম বলেন আপনারা নিউজ করে যদি কিছু করতে পারেন তাহলে করেন কোন সমস্যা নেই।

২০২৪ সালে একুশে আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় তার নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যেখানে তারা অবৈধ সম্পদের মধ্যে উল্লেখ আছে একটি দামি হাইয়েস গাড়ি, সাভারে মসূরী খোলা এলাকায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের একটি জমির প্লট , ময়মনসিংহ ভালুকায়ে রয়েছে গরুর খামার, সৌদি আরবের রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা।

মোটকথা পল্লবী সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সবকিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে উমেদার জসিম, পল্লবী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সাব রেজিস্টারদের এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এই উমেদার জসিম এবং সকল অর্থের লেনদেন তার হাত ধরেই হয়।

জনসেবার নামে ভণ্ডামি

প্রতি ঈদে জসিম বিপুল অর্থ বিতরণ করেন, কোরবানিতে একাধিক গরু দেন, দরিদ্রদের মাঝে চাল–ডাল–টাকা বিলান। অনেকেই তাকে ‘দানবীর’ মনে করেন। কিন্তু স্থানীয় সচেতনরা বলেন, “এটা আসলে দুর্নীতির টাকা সাদা করার কৌশল। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই দান।”

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

জসিম ও রাজিবের সিন্ডিকেট শুধু ঘুষই নেয় না, বরং দলিল জালিয়াতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সর্বনাশে ফেলে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—

  • দলিলের পাতা ছিঁড়ে ফেলা

  • ভলিউম পরিবর্তন

  • দাগ ও খতিয়ান পরিবর্তন

  • জমির শ্রেণী বদল

  • রেজিস্ট্রেশনের সময় গ্রাহককে হয়রানি

  • দলিল দেখতে এলেও টাকা ছাড়া নড়াচড়া না করা

ফলে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পান না।

বদলি হলেও বহাল তবিয়তে

বছরের পর বছর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসন একাধিকবার বদলি করেছে। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারণে কিছুদিনের মধ্যেই আবার তারা একই অফিসে ফিরে আসেন। ফলে স্থানীয়রা বলছেন,
“পল্লবী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক সাব-রেজিস্ট্রার নয়, বরং এই দুই উমেদার।”

ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা

মিরপুরের এক ভূমিমালিক বলেন—
“একটা জমির দলিল করতে গিয়ে পাঁচবার অফিসে দৌড়াতে হয়েছে। প্রতিবার আলাদা অজুহাতে টাকা চেয়েছে। না দিলে কাজই হয় না।”

আরেক দলিল লেখক অভিযোগ করেন—
“আমরা বাধ্য হয়ে টাকা দিই। উমেদাররা এখন অফিসের রাজা। তাদের ছাড়া কোনো কাজ হয় না।”

আইনের চোখে অবৈধ সম্পদ

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, দৈনিক ৬০ টাকা হাজিরার উমেদারের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ। দুর্নীতি দমন কমিশন চাইলে খুব সহজেই তার সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করতে পারে।

এক সাবেক সচিব বলেন—
“এসব উমেদারই আসলে পুরো সাব-রেজিস্ট্রি সেক্টরের দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”

জনমতের দাবি

পল্লবী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে সাধারণ মানুষের প্রথম অভিযোগ—
“এখানে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না।”

জনগণের দাবি, সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন যেন অবিলম্বে উমেদার জসিম ও রাজিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়। না হলে এই অফিস দুর্নীতির ক্যান্সারে পরিণত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *