মোহাম্মদ হোসেন সুমন:
সোমবার (২৫ আগস্ট) কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সংলাপে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই ও স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ, সম্মানজনক এবং টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য সাত দফা দাবি উত্থাপন করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যার মূল উৎপত্তি মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানেই খুঁজতে হবে।”
এই সংলাপের দ্বিতীয় দিনে অংশগ্রহণের আগে, সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা। সংলাপে তিন দিনের কর্মসূচি চলবে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত।
ড. ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এত বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুকে ধারণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সংকট শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, এটি একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
তিনি আরও বলেন, “দেশ এখন স্থিতিশীল, আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।” একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিরত সহযোগিতা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি জানান, সরকার রোহিঙ্গাদের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে এবং বৈশ্বিক মঞ্চে এই সংকটকে তুলে ধরে নিরাপদ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ৭ দফা প্রস্তাবনা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের ভয়াবহ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে সশস্ত্র ঘাতকদের থামানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ২০১৭ সালে এবং তারও আগে, সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মিকে নিশ্চিত করতে হবে, যেন আর কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ না করে।”
প্রধান উপদেষ্টার উত্থাপিত ৭ দফা দাবি নিম্নরূপ:
১. নাগরিকত্ব পুনঃপ্রদান: রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের দীর্ঘদিন ধরে অমানবিকভাবে রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে, যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত: জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য মিয়ানমারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়।
৩. নিরাপত্তা ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন: প্রত্যাবাসন অবশ্যই রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় হতে হবে। তাদের ওপর কোনো প্রকার চাপ বা জবরদস্তি প্রয়োগ করা হবে না।
৪. আসিয়ান দেশগুলোর সম্পৃক্ততা: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সংকটে প্রতিবেশী আসিয়ান (ASEAN) দেশগুলোকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা ছাড়া এই সংকটের সমাধান অসম্ভব।
৫. গণমাধ্যম ও এনজিওর অবাধ চলাচল: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর (NGO) জন্য রাখাইন রাজ্যসহ আরাকান অঞ্চলে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সঠিক তথ্যপ্রবাহ ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত হয়।
৬. আসল গ্রামে পুনর্বাসন: রোহিঙ্গাদের কোনো অস্থায়ী ক্যাম্পে নয়, তাদের নিজস্ব গ্রামে ও স্থায়ী আবাসে পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের সম্পত্তির ওপর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৭. নির্যাতন বন্ধ: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সব ধরনের নিপীড়ন, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ মানবিক দায়িত্ব থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু আমরা এই দায়িত্ব অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করতে পারি না। মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি এবং আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর উচিত এখনই শক্ত অবস্থান নেওয়া।”
তিনি আরও সতর্ক করেছেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে এর প্রভাব শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তাজনিত ও সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।”
গতকাল রোববার (২৪ আগস্ট) থেকে উখিয়ার ইনানীর হোটেল বে-ওয়াচ মিলনায়তনে শুরু হয়েছে ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়লগ অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’। উদ্বোধনী দিনে সরকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—বাংলাদেশ আর কোনো রোহিঙ্গাকে দেশে প্রবেশ করতে দেবে না।
প্রথম দিনের আলোচনায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এবং বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। মূল আকর্ষণ ছিলেন প্রায় একশ রোহিঙ্গা প্রতিনিধি। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ জোরদারের আহ্বান জানান। মুসলিম দেশগুলোকে বিশেষভাবে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান তারা।
সংলাপে বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তরিক। তবে নতুন করে আর কাউকে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ প্রান্তে সীমান্ত রক্ষায় দায়িত্বে থাকা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে আছে, যেন নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে। এরইমধ্যে এটি আমাদের জন্য একটি বড় সংকট।”
প্রায় আট বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ১৮ কোটির বেশি মানুষের দেশে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশ নতুন সংকটে পড়েছে। তাই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এখন সময়ের অন্যতম দাবি।