৬ বছরের লাঞ্ছনায় বন্ধী ভারতীয় নাগরিক রামদেব মাহাতোর মুক্তি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: 

অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে গ্রেফতার হওয়া ভারতীয় নাগরিক রামদেব মাহাতো (৬০) শেষ পর্যন্ত দেশে ফেরার আনন্দ পেয়েছেন। একে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পরও ঠিকানার ভুলের কারণে ৬ বছর ৩ মাস ১৬ দিন বাংলাদেশি কারাগারে অতিরিক্ত সময় কাটাতে হয়েছিল। অবশেষে মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক শামসুল হুদার বিশেষ প্রচেষ্টায় রামদেব মাহাতো সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সোনামসজিদ সীমান্তে পৌঁছে ভারতীয় পরিবারে হস্তান্তরিত হয়েছেন।

গ্রেফতার ও সাজা
রামদেব মাহাতো ভারতের বিহার রাজ্যের পশ্চিম চাঁমপাড়ান জেলার গুদ্রা গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে স্থানীয় আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়। সাজার মেয়াদ ২০১৯ সালের ২৯ মে শেষ হওয়ার পরও তাকে দেশে ফেরানো সম্ভব হয়নি।

ঠিকানার ভুলের কারণে দীর্ঘ বন্দিত্ব
রামদেবের দেশে ফেরার পথ আটকে দেয় গ্রেফতারের সময় নথিভুক্ত ঠিকানার ভুল। গ্রেফতারের সময় রামদেব হিন্দি ভাষায় তার নাম ও ঠিকানা জানিয়েছিলেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তা ঠিকভাবে বুঝতে না পারায় নথিতে ভুলভাবে লেখা হয়। ফলে, সাজা শেষে কারাগার কর্তৃপক্ষ তাকে ফেরানোর চেষ্টা করলেও ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শামসুল হুদার প্রচেষ্টা
মানবাধিকারকর্মী শামসুল হুদা বিষয়টি জানতে পেরে তদন্ত শুরু করেন। ২৩ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলার জাকির হোসেন বিষয়টি তাকে জানান। শামসুল হুদা তথ্য-প্রযুক্তি ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নথিতে থাকা ভুল স্থানের কাছাকাছি জায়গার নাম খুঁজে বের করেন এবং ভারতের বিহারের গুদ্রা গ্রামে পৌঁছে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান লাল বাচ্চা যাদবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রামদেবের ছবি পাঠানোর মাধ্যমে পরিবারকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

এরপর ২৩ নভেম্বর ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে রামদেবের প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাঠানো হয়। জাতীয় পরিচয় ও নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই শেষে ভারতীয় দূতাবাস বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছাড়পত্র প্রেরণ করেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্রের আদান-প্রদানের মাধ্যমে তার দেশে ফেরার অনুমতি মিলে।

ফেরার মুহূর্ত ও শুভেচ্ছা
সোমবার সকালেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারাগার থেকে রামদেবকে বের করে সোনামসজিদ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন ছেলে সুনীল মাহাতো, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান লাল বাচ্চা যাদব, বিএসএফ সদস্যরা, পাশাপাশি বাংলাদেশি পুলিশ, বিজিবি ও কারারক্ষীরাও। সঙ্গে ছিলেন শামসুল হুদা, যিনি পরিবারের হাতে রামদেবকে হস্তান্তর করতে পেরে খুশি প্রকাশ করেন।

শামসুল হুদা জানান, “গ্রেফতারের সময় যে ঠিকানাটি দেওয়া হয়েছিল তা ভুল ছিল। তথ্য প্রযুক্তি ও স্থানীয় যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা ঠিকানা শনাক্ত করতে পেরেছি। দেশের বন্দী ভারতীয় নাগরিকদের ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”

বিদেশী বন্দীদের জন্য মানবিক উদ্যোগ
শামসুল হুদা দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী বিদেশীদের দেশে ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৮০ বিদেশী বন্দীর বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন, যার মধ্যে ৫২ জনকে দেশে ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া ভারতে পাচার হওয়ার পর দেশটির কারাগারে থাকা কিছু নারীও তিনি দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। এই কার্যক্রমের জন্য শামসুল হুদা ‘বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান’ নামে পরিচিত।

তিনি আরও জানান, কারা অধিদপ্তর থেকে গত কয়েক মাসে ১৪০ জন ভারতীয় নাগরিকের তালিকা পেয়েছেন, যার অধিকাংশেরই ঠিকানা অনুপস্থিত। শামসুল হুদা ইতিমধ্যে তাদের পরিবার খুঁজে বের করতে শুরু করেছেন এবং দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া নিয়েছেন।

রামদেব মাহাতোর দীর্ঘ বন্দিত্ব ও তার দেশে ফেরার গল্প মানবিক সহমর্মিতা, সচেতনতা ও তথ্য-প্রযুক্তির সংমিশ্রণ হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের এক অনন্য উদ্যোগের প্রতিফলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *