এ এম এম আহসান :
রাজধানী ঢাকায় প্রবেশের অন্যতম প্রধান পথ সাইনবোর্ড থেকে মাতুয়াইল মেডিকেল পর্যন্ত মহাসড়ক প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই পরিণত হয় এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। সারি সারি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রাস্তার জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে সৃষ্ট হয় দীর্ঘ যানজট, ভোগান্তির শিকার হয় হাজারো মানুষ। অথচ এ সময় ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি থাকে নামমাত্র।
স্থানীয় সাদ্দাম মার্কেট (কদমতলী) এলাকা থেকে সরেজমিনে দেখা যায়—গাড়ির দীর্ঘ লাইন এমনকি পাশাপাশি গাড়ি দাঁড় করিয়ে জ্যাম তৈরি করছে, সাধারণ গাড়ি, অফিসগামী মানুষ, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত আটকে যাচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা।
পরিকল্পিত চাঁদাবাজির ফাঁদ
ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চালকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, যানজট কোনো দৈবক্রমে নয়, বরং এটি পরিকল্পিত চাঁদাবাজির ফলাফল।
প্রতিটি গাড়ি থেকে নেওয়া হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
প্রতিদিন দাঁড় করানো হয় প্রায় ৪০০–৫০০ গাড়ি।
সে হিসেবে দৈনিক চাঁদাবাজির অঙ্ক দাঁড়ায় কমপক্ষে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।
এই অর্থ ভাগ হয় মাঠপর্যায়ের ট্রাফিক সার্জেন্ট থেকে শুরু করে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে।
যানবাহন চালকদের ভাষ্য অনুযায়ী, টাকা না দিলে গাড়িকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে ধীরগতিতে ছাড়ানো হয়, এমনকি হুমকি দেওয়া হয় মামলা বা জরিমানার।
ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা
প্রতিদিনের এই অব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষকে পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগে।
কাঁচা বাজারে যাওয়া থেকে শুরু করে অফিসগামী মানুষ পর্যন্ত আটকে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা।
স্কুল শেষে ঘরে ফেরা শিক্ষার্থীরা ভোগে অসহ্য কষ্ট।
সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার গাড়ি। অনেকে বলেন, প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটছে এই অব্যবস্থাপনার কারণে।
একজন চালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—
“মালিকের গাড়ি চালাই, গরিব মানুষ। পুলিশকে টাকা না দিলে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে ঘন্টার পর ঘন্টা। মামলা দিলে জরিমানা কয়েক হাজার টাকা। তাই বাধ্য হয়েই প্রতিদিন টাকা দিতে হয়।”
অর্থনৈতিক ক্ষতি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের চাঁদাবাজি কেবল দুর্নীতির বিষয় নয়, এটি দেশের অর্থনীতির ওপর সরাসরি আঘাত।
প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার যানজটে আটকে যায় হাজারো কর্মঘন্টা।
শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হয়।
পণ্যবাহী গাড়ির বিলম্বে ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
পরিবহন বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরে এই অব্যবস্থাপনা ও চাঁদাবাজির কারণে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় শত কোটি টাকার ওপরে।
কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানো
অভিযোগ উঠেছে, ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই চক্রের বিষয়টি জানলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বরং অনেকে নীরবে ভাগ নিচ্ছেন চাঁদাবাজির অর্থ থেকে। ফলে মাঠপর্যায়ের সার্জেন্টরা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছেন।
একজন পরিবহন মালিক বলেন—
“আমরা চাই আইনের শাসন। কিন্তু যারা আইন রক্ষক, তারাই যদি চাঁদাবাজ হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?”
নগরবাসীর প্রশ্ন
প্রতিদিন ভোগান্তিতে জর্জরিত নগরবাসী জানতে চাইছে—
ঢাকার প্রবেশমুখে প্রতিদিনের এই চাঁদাবাজি ও যানজট বন্ধ করবে কে?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরের এই দুর্নীতির দায় নেবে কে?
যানজট ও দুর্নীতির এই অভিশাপ থেকে নগরবাসী কবে মুক্তি পাবে?
একটি শহরের সভ্যতার পরিচয় তার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। আর যদি রাজধানীর প্রবেশপথই প্রতিদিন পরিণত হয় চাঁদাবাজির ঘাঁটিতে, তবে উন্নয়নের স্লোগান কেবলই ধোঁয়াশা ছাড়া কিছু নয়।