তিন আদালতের রায়ও কাজে লাগেনি: ৮৬ নারী প্রশিক্ষকের বঞ্চনার শেষ নেই

এ এম এম আহসান:

২৭ বছর ধরে মাসে দুই হাজার টাকায় কাজ

রায় বাস্তবায়নের নামে কোটি টাকার প্রতারণা,

ফাইল জব্দ এক বছরেরও বেশি সময়

নারী উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে একসময় পরিচিত জাতীয় মহিলা সংস্থা এখন হয়ে উঠেছে বঞ্চনা ও প্রতারণার প্রতীক।
সংস্থাটির ৮৬ নারী ট্রেড প্রশিক্ষক ২৭ বছর ধরে কাজ করছেন মাসে মাত্র দুই হাজার টাকায়। তিন তিনটি আদালতের রায় তাঁদের পক্ষে গেলেও এখনো চাকরি স্থায়ী হয়নি, জাতীয় বেতন স্কেলেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তাঁদের অভিযোগ, রায় বাস্তবায়নের আশ্বাসে সংস্থার এক কর্মকর্তা প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে ফাইল জব্দ করে রেখেছেন নির্বাহী পরিচালকের দপ্তরে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। ফলে আদালতের রায় কাগজে থাকলেও বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

২৭ বছর ধরে দুই হাজার টাকায় কাজ

১৯৯৭ সালে তৎকালীন চেয়ারম্যান বেগম আইভি রহমানের উদ্যোগে দেশের ৬৪ জেলা ও ৫০ উপজেলায় দর্জি ও বয়স্ক শিক্ষা প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন মাসিক সম্মানি ছিল ২০০ টাকা; পরে তা বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করা হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের পর থেকে আর এক টাকাও বাড়েনি।

২৭ বছর ধরে একই টাকায় কাজ করা এই নারীদের অনেকে এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব। কেউ অসুস্থ, কেউ সংসারের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ বঞ্চনার হতাশায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

একজন দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষক বলেন,
“আমরা দেশের নারীদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করি, অথচ নিজেরাই এখন ভাতাও টানতে পারি না।
আদালতে জিতেছি, কিন্তু জীবনে হেরেছি।”

তিন আদালতের রায়—সবই প্রশিক্ষকদের পক্ষে

বছরের পর বছর আবেদন ও স্মারকলিপি বিফল হওয়ার পর ২০১০ সালে জেলা পর্যায়ের ৩৩ জন প্রশিক্ষক হাইকোর্টে রিট করেন (নং ৩৩০/২০১০ ও ৩৭৮২/২০১০)। ২০১২ সালের ২ আগস্ট আদালত তাঁদের পক্ষে রায় দেন।

এরপর বয়স্ক শিক্ষা প্রশিক্ষকরাও পৃথক দুটি রিট (নং ১৬০১৫/২০১২ ও ২৯৯৯/২০১৩) দায়ের করেন। ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর হাইকোর্ট একইভাবে তাঁদের পক্ষে রায় দেন। সরকার আপিল করলেও ২০১৭ সালের ২ জুলাই উচ্চ আদালত রায় বহাল রাখে।

সবশেষে ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল রিভিউ মামলা (নং ৭/২০২২ ও ৮/২০২২)-তেও সুপ্রিম কোর্ট আগের রায় বহাল রাখে।
তবুও সেই রায় আজও বাস্তবায়িত হয়নি—ফাইলের পাতায় বন্দি হয়ে আছে তাঁদের প্রাপ্য অধিকার।

ফাইল ঝুলে আছে এক বছর ধরে

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় রায় বাস্তবায়নের ফাইল পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়ন–৩ শাখায় (পত্র সূত্র: ০৭.২০.০০০০.১৬৩.০৪.২০৭.২২–৯২)।
আগস্টে আইন শাখা নির্বাহী পরিচালককে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, ফাইলটি এখন সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের দপ্তরেই জব্দ অবস্থায় পড়ে আছে।
ফলে এক বছর পার হলেও রায় বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন।

রায় বাস্তবায়নের আশ্বাসে প্রতারণা

প্রশিক্ষক নারীদের অভিযোগ, সংস্থার তৎকালীন জেলা কর্মকর্তা মফিজ মিয়া, বর্তমানে কেন্দ্রীয় দপ্তরে কর্মরত, “রায় বাস্তবায়ন ও জাতীয় স্কেলে অন্তর্ভুক্তির আশ্বাসে” তাঁদের কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন।

তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে—২০২২ সালে কেন্দ্রীয় দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি নিয়োগ ও পদায়ন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্প, জেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষক, এমনকি গ্রামীণ কর্মচারীদের কাছ থেকেও অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে।

তাঁর সহযোগী ছিলেন পিয়ারলি থেকে আগত এক ব্যক্তি ও আয়েশা কার সহকারী সচিব রেজাউল (বর্তমানে পিআরএল)। এঁরা একযোগে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষক ও প্রকল্পকর্মীদের কাছ থেকে প্রায় ১৬ লক্ষাধিক টাকা ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল লেনদেনের মাধ্যমে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া মফিজ মিয়া মতিঝিলের একটি সরকারি কোয়ার্টারে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তিনি সেটি দখল করেছেন এক “চাচা”-র নামে, যিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরি শাখায় কর্মরত। অভিযোগ রয়েছে, এই আত্মীয়ের প্রভাব খাটিয়ে তিনি সরকারি কোয়ার্টার দখলসহ একাধিক অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছেন।

একজন নারী প্রশিক্ষক ক্ষোভভরে বলেন,
“মফিজ শুধু টাকা নেয়নি, আমাদের রায়ও আটকে দিয়েছে। ফাইল জব্দ রেখে নির্বাহী পরিচালককেও বিভ্রান্ত করছে।”

৩৩ জন পেয়েছেন স্কেল, ৮৬ জনের ফাইল জব্দ

সূত্র জানায়, আদালতের রায়ের পর ৩৩ জন নারী প্রশিক্ষককে জেলা পর্যায়ে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাকি ৮৬ জনের ফাইল এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের দপ্তরে জব্দ অবস্থায় পড়ে আছে।
ফলে একদিকে আদালতের রায় বাস্তবায়িত হয়েছে আংশিকভাবে, অন্যদিকে বাকি নারীরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন একটি প্রশাসনিক স্বাক্ষরের জন্য।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব শাহানা শারমিন বলেন,
“আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। সব কাগজ যাচাই-বাছাই চলছে। আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যে ফাইল অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।”

তবে প্রশিক্ষকরা বলছেন, এমন আশ্বাস তাঁরা বছরের পর বছর ধরে শুনছেন, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আসে না।

‘রাষ্ট্র কি আমাদের ভুলে গেছে?’

এই ৮৬ নারী প্রশিক্ষকের অনেকে এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব। কেউ অসুস্থ, কেউ জীবনের সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছেন। তবুও তাঁরা প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, শুধু আশায়—একদিন হয়তো রায় বাস্তবায়ন হবে।

একজন বয়স্ক শিক্ষা প্রশিক্ষক চোখ মুছে বলেন,
“আমরা জীবনের অর্ধেক সময় এই সংস্থার জন্য দিয়েছি।
আজ তিনটি আদালতের রায় নিয়েও প্রাপ্যটা পাইনি।
রাষ্ট্র কি আমাদের ভুলে গেছে?”

প্রশিক্ষকদের দাবি

আদালতের রায় অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা, জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তি ও চাকরি স্থায়ী করা, বকেয়া বেতন ও ভাতা প্রদান, এবং দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা—এই চারটি দাবিই এখন তাঁদের জীবনের একমাত্র প্রত্যাশা।

আইনের রায় বনাম প্রশাসনের নীরবতা

এই ঘটনা শুধু ৮৬ নারী প্রশিক্ষকের নয়—এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর নীরব ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
একদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তিন ধাপের রায়, অন্যদিকে বছরের পর বছর গড়িমসি—এ যেন আইনের শাসনের সামনে রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার নগ্ন উদাহরণ।

নারী উন্নয়নের পতাকা হাতে থাকা সংস্থাই আজ নারী বঞ্চনার সবচেয়ে বড় প্রতীক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *