ডেইরি ফার্মের আড়ালে পাহাড় কাটার বাণিজ্য

স্টাফ রিপোর্টার :

চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড় কাটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ‘পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার’ সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র একের পর এক পাহাড় কাটছে। গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে অন্তত ১২০টি পাহাড় কেটে ফেলেছে। বাকি যে পাহাড়গুলো আছে সেগুলোও কেটে চট্টগ্রামকে পাহাড়শূন্য করার তোড়জোড় চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার কথা স্বীকার করে বলেছে, লোকবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় পাহাড়খেকোদের ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

জালালাবাদ এলাকার পাশাপাশি ফয়’স লেকের লেকভিউ আবাসিক এলাকার পাশে সুউচ্চ একটি পাহাড় কেটে ফেলতে দেখা গেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সামনে জনতা ডেইরি ফার্ম নামের একটি গরুর খামার করে পেছনে সুউচ্চ একটি পাহাড় কাটা হচ্ছে। স্থানীয় মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি পাহাড়টি কাটছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

আলতাফ হোসেন নিজেকে জনতা ডেইরি ফার্মের মালিক এবং লেকভিউ আবাসিক এলাকার সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে বলেন, পাহাড়টি ভেঙে পড়েছিল। আমি একটু ড্রেজিং করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। স্থানীয়রা একটি মাদ্রাসা করতে বলেছেন। তাই মাদ্রাসা করার জন্য কাজে হাত দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু লোকজন এসে বাধা দেওয়ায় পাহাড় কাটা বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, তিনজন মানুষ দুদিন পাহাড় থেকে মাটি সরিয়েছিল।

জালালাবাদে বিস্তৃত এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফৌজদারহাট–বায়েজিদ লিংক রোডের পাশের সুউচ্চ অনেক পাহাড় রাতে–দিনে কাটা হচ্ছে। সংববদ্ধ একটি চক্র বিশাল একটি এলাকা নিয়ে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি পাহাড় কেটেছে জানিয়ে স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, ইতোপূর্বে কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড়খেকোদের দমাতে পারেনি। অভিযানের খবর আগেভাগে পেয়ে তারা গা ঢাকা দেয়। মামলাকে দুর্বৃত্তরা পাত্তা দেয় না বলে মন্তব্য করে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাহাড় কাটা নিয়ে একাধিক মামলা হলেও পাহাড়খেকোরা দমেনি।

একটি গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭৬ সালে নগরীর পাঁচটি থানা এলাকায় ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার পাহাড় ছিল। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে ঠেকে। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কেটে ফেলা হয়। এটি মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ।

নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় অসংখ্য পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে পাঁচলাইশ থানায়। এখানে প্রায় ৭৪ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়েছে। ত্রিশ বছর নগরীতে ১২০টির মতো পাহাড় বিলুপ্ত হয়েছে। নগরীতে আগে ২০০টি পাহাড় ছিল। ইতোমধ্যে ১২০টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ৮০টির মতো পাহাড় টিকে আছে। এখনো অনেক পাহাড় কাটা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বায়েজিদ বোস্তামী ও খুলশীর জালালাবাদ এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে ফয়’স লেকের লেকভিউ আবাসিক এলাকা এবং জঙ্গল সলিমপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতা অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পুলিশের তৎপরতায় ছন্দপতন ঘটে। ইতোমধ্যে পুলিশ কাজে যোগ দিলেও ছন্দ পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এতে করে পাহাড়খেকোদের পোয়াবারো অবস্থা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ফলে রাতে–দিনে সমানতালে পাহাড় কাটা হচ্ছে নগরীতে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়খেকোরা বেপরোয়া। নানা কৌশলে তারা পাহাড় কাটে। এদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর বহু অভিযান করেছে, মামলা করেছে। কিন্তু তারা ঠিকই রাতের আঁধারে পাহাড় কাটছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত ক্রাশ প্রোগ্রাম ছাড়া পাহাড়খেকোদের দমন করা যাবে না। তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে ধরে তাৎক্ষণিকভাবেই কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। স্থাপনা গড়ে তুললে ভেঙে ফেলতে হবে। সিডিএ প্ল্যান দিলে সেগুলো বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং ওয়াসার সংযোগ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। তাহলেই কেবল এসব পাহাড়খেকোকে ঠেকানো যাবে।

তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন গিয়ে অভিযান করলাম। মামলা করলাম। কিন্তু আমরা ফিরে আসার পর আবার তারা পাহাড় কাটা শুরু করে। পাহাড় কাটা এত লাভজনক যে, এক কাঠা জায়গা বের করতে পারলে লাখ লাখ টাকা। পাহাড়ের মাটি বিক্রি করেও কামানো হয় টাকা। কাঁচা টাকার এমন রমরমা অবস্থায় ঢাল তলোয়ারবিহীন কোনো উদ্যোগ কোনোদিনই সফল হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *