টিসিবির পণ্যের মোড়ক বদলে বিক্রি: বনশ্রীর আবুল খায়ের প্রতারণার সাম্রাজ্য!

এ এম এম আহসান:

সরকার দরিদ্র জনগণের জন্য যে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে, সেটিই এখন অসাধু ব্যবসায়ীদের আয়-রোজগারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। রাজধানীর বনশ্রীয়ের মেরাদিয়া বাজারে টিসিবির অনুমোদিত ডিলার আবুল খায়ের বছরের পর বছর ধরে টিসিবির চাল, ডাল, তেল ও আটা মোড়ক বদলে বাজারজাত করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই ব্যবসায়ী “মেসার্স ময়নামতি স্টোর” নামে টিসিবির ডিলারশিপ নিয়ে সরকারের ভর্তুকির পণ্য দরিদ্রদের মাঝে না দিয়ে গোপনে গুদামজাত করে নতুন প্যাকেটে বাজারে বিক্রি করছেন।

রাতের অন্ধকারে প্রতারণার কারখানা

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আবুল খায়ের তিনটি গোপন গোডাউন রয়েছে বনশ্রী ও মেরাদিয়া এলাকায়। প্রতিরাতে সাঁটার বন্ধ রেখে এসব গুদামে কর্মচারীরা টিসিবির বস্তা ও বোতলের মোড়ক বদলায়। নতুন নামে ও ব্র্যান্ডে মোড়ক তৈরি করে সেই পণ্য পরে ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান,
“অনেকদিন ধরেই ওরা রাতে কাজ করে, ভোরে ট্রাক আসে, পণ্য যায়। সবাই জানে, কিন্তু খায়ের ভয় পায়।”

‘ম্যানেজ করেই ব্যবসা চালাই’ — খায়ের দম্ভোক্তি ও হুমকি

এ বিষয়ে আবুল খায়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেন। পরে আবার ফোন করে অস্বীকার করেন এবং প্রতিবেদককে হুমকি দিতে শুরু করেন। তিনি বলেন,
“প্রশাসন থেকে সাংবাদিক—সবাইকে ম্যানেজ করেই আমি ব্যবসা চালাচ্ছি। পারলে কিছু করেন।”

এরপর থেকেই স্থানীয়ভাবে সংবাদকর্মীদের প্রতি চাপ, ভয়ভীতি ও হুমকির ঘটনা ঘটতে থাকে।

আইনি অবস্থান ও প্রশাসনের ভূমিকা

টিসিবির নীতিমালা অনুযায়ী, ভর্তুকিপ্রাপ্ত পণ্য অন্যভাবে বিক্রি করা বা মোড়ক পরিবর্তন করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এই অপরাধে ডিলারশিপ বাতিলের পাশাপাশি জরিমানা ও সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবুও এখনো পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন,
“অভিযোগ পেয়েছি, যাচাই-বাছাই চলছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

দরিদ্রের প্রাপ্য পণ্য বাজারে

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে ৫০০টিরও বেশি ডিলারের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় দেড় কোটি নিম্নআয়ের পরিবারকে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অসাধু ডিলারদের কারসাজির কারণে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“যাদের জন্য সরকার পণ্য দেয়, তারা পায় না। বরং এই খায়ের মতো ব্যবসায়ীরা তা বিক্রি করে লাখপতি হচ্ছে।”

টিসিবির নিয়ম ও অপরাধের ধারা

বিষয়: তথ্য

উদ্দেশ্য: নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ
পণ্যসমূহ: চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা
নিষিদ্ধ কাজ: মোড়ক বদল, গুদামজাত, পুনর্বিক্রি, মজুতদারি
আইনি শাস্তি: ডিলারশিপ বাতিল, জরিমানা ও সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড
তদারকি সংস্থা: ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), স্থানীয় প্রশাসন

সবার জানা উচিত

  • সরকারি ভর্তুকি পণ্য পুনরায় বিক্রি করা সরাসরি জনগণের সম্পদের অপব্যবহার।

  • প্রশাসনের দুর্বল তদারকির সুযোগে টিসিবির নামে গড়ে উঠছে প্রতারণার চক্র।

  • এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে টিসিবি, ভোক্তা অধিকার এবং দুদকের যৌথ অভিযান প্রয়োজন।

  • জনগণের করণীয়: এমন অনিয়ম দেখলে সরাসরি টিসিবি হটলাইন বা থানায় অভিযোগ করুন।

কেন তদারকি ব্যর্থ?

টিসিবির উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য-পীড়িত মানুষকে সহায়তা করা; কিন্তু মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে সেই উদ্যোগ আজ ব্যবসায়ীদের লোভে পরিণত হয়েছে। দুর্বল মনিটরিং, প্রশাসনের উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব—এই তিন কারণে টিসিবি কার্যক্রম আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার যদি এখনই কড়া পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে টিসিবির ওপর জনগণের আস্থা চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।

স্থানীয়দের দাবি

“দরিদ্রের হক মেরে যারা পকেট ভারী করছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নইলে টিসিবি নামটা মানুষের কাছে তামাশা হয়ে যাবে।”

১. টিসিবির চাল-ডাল-তেল বাজারে! বনশ্রীর আবুল খায়ের প্রতারণা ফাঁস
২. ‘ম্যানেজ করেই ব্যবসা চালাই’ — টিসিবি ডিলার আবুল খায়ের দম্ভোক্তা!
৩. দরিদ্রের হক বিকিয়ে ধনকুবের খায়, প্রশাসন নীরব কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *