মুহাম্মদ জুবাইর:
চট্টগ্রাম জেলা রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও তার পুত্র ফারাজ করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, হয়নি, আয়না ঘর, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাচেষ্টা, হত্যা, অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো, অস্ত্রের মুখে জমি লিখিয়ে নেয়া, দখল, এবং অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। বাপ বেটার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় বর্তমানে ডজনেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ফজলে করিম চৌধুরী জেল হাজতে থাকলেও তার ছেলে পলাতক।
ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ:
হত্যা মামলা: বর্তমানে ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরু হত্যার মামলায় ফজলে করিম চৌধুরীকে ৩ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
অপহরণ ও হত্যা: ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে নগরের চন্দনপুরার বাসা থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় নুরুল আলম নুরুকে। রাউজান থানার এসআই শেখ মুহাম্মদ জাবেদ এই অপহরণের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন।
জমি দখল: ফজলে করিম চৌধুরী তার ক্ষমতার দাপটে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল করেছেন।
অস্ত্রের ব্যবসা: তার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ রয়েছে একাধিক।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত: পবিত্র কোরআন শরীফ পোড়ানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, এবাদতখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, নগদ অর্থ, প্রয়োজনীয় দলিলপত্র ও সম্পদ লুট, অগ্নিসংযোগ, হত্যার চেষ্টাসহ নানা অভিযোগে সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ও তার পুত্র সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ ফারাজ করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাউজান থানায় আরও একটি মামলাও রয়েছে।
২৬ আগস্ট মামলাটি দায়ের করেন রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের এয়াসিন নগরের বাসিন্দা এবং ত্বরিকত ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের ২০৪ নম্বর ফকির টিলা শাখার সহ-সভাপতি মো. জোহেল উদ্দিন। মামলায় এই বাপ-বেটা ছাড়াও রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল, পৌরসভা মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ, পৌর প্যানেল মেয়র বশির উদ্দিন খান, পৌর কাউন্সিলর কাজী ইকবালসহ ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০–৩০ জনকে আসামী করা হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ৬ টার পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এজাহারনামীয় আসামী সাংসদ এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, পৌর মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ, উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল ও ফারাজ করিম চৌধুরীর নির্দেশে বাকী আসামীসহ ২০–৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ধারালো কিরিচ, ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, ধারালো দা, লোহার রড, হাতুড়ি, রামদা, মাস্তুল ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বুলডোজারসহ ঘটনাস্থলে অর্থাৎ মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের ২০৪ নং ফকিরটিলা শাখা (এবাদত খানা)-র সামনে এসে শক্তির মহড়া প্রদর্শন ও এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। আসামীগণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গালিগালাজ করে শাখা কার্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অনধিকার প্রবেশ করে, শোর-চিৎকার করে, ফাঁকা গুলি ছেড়ে আতংক সৃষ্টি করে।
লোহার রড দিয়ে শাখার ডিজিটাল সাইনবোর্ড, দরজা, জানালা ও গ্লাস ভেঙ্গে ফেলা হয়। লোহার রড, হকিস্টিক, হাতুড়ি, রামদা, মাস্তুল দ্বারা এবাদতখানার ১ (এক) তলা ভাঙা শুরু করা হয়। পরে বুলডোজার দিয়ে শাখা কার্যালয় (এবাদত খানা)-এর একতলা ভবন এবং উক্ত এবাদত খানাস্থ ৪টি ভাড়া দোকান—ফার্মেসী, মুরগীর দোকান, স্টেশনারি দোকান, চায়ের দোকান—ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এসময় তারা শাখার বড় স্ট্যান্ড ফ্যান, কাঠের আলমারি, অন্যান্য দামী সামগ্রীসহ লোহার রড, ইট, দোকানের মালামালসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার লুট করে নেয়। যাওয়ার প্রাক্কালে এবাদত খানা ও কার্যালয়ের ভেতরে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে শাখার কার্যালয়ে থাকা বিভিন্ন আসবাবপত্র, কাগজপত্র, বিশেষ করে পবিত্র কোরআন শরীফ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এবাদতখানা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ পুরো কার্যালয়টি একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়।
মামলার বাদী মোহাম্মদ জোহেল উদ্দিন জানান, বর্তমানে কার্যালয়টি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। উক্ত ঘটনার বিষয়ে তৎকালীন সময়ে স্থানীয় প্রশাসন থেকে কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় এবং ১নং আসামী এলাকার তৎকালীন ক্ষমতাসীন সংসদ সদস্য, ২নং আসামী পৌরসভার মেয়র ও ৩নং আসামী উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারে বাদী সহ মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে।
দীর্ঘদিন যাবৎ নিজ এলাকায় অবস্থান করতে না পারায় এবং রাজনৈতিক হয়রানির স্বীকার হওয়ায় এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হয়। উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী সরকার পতনের পর গত ২৩ আগস্ট রাউজান থানায় রাউজানে একছাত্র অধিপত্যে বিস্তারকারী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়।
মুনিরিয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের ১০৩ নম্বর দলইনগর-নোয়াজিষপুর শাখা (এবাদত খানা) ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এবাদত খানায় অবস্থানরত সদস্যদের হত্যার চেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন উক্ত শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন।
এর পাশাপাশি গত ১৯ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাবেক সংসদ ফজলে করিম চৌধুরীসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন পশ্চিম গুজরা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. সিরাজদৌল্লাহ। এবং ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই সংসদ সদস্যসহ ২৩ জনকে আসামী করে দ্রুত বিচার আইনে আরেকটি মামলা হয় (মামলা নং-১৬/২০২৪)। মামলাটি দায়ের করেন বিনাজুরী ইউনিয়নের বাসিন্দা ইসতিয়াক হোসেন প্রকাশ বজল।
সাবেক এই প্রভাবশালী সংসদের বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়। চট্টগ্রাম-৬ আসন এই ফজলে করিম চৌধুরীর কথাই ছিল শেষ কথা: বাংলাদেশ থেকে আলাদা রাষ্ট্র মনে করতেন রাউজানকে ফজলে করিম চৌধুরী। নিজেকে এলাকায় প্রচার করেছেন, তিনি একমাত্র অত্র এলাকার রাজা, তার কথাই শেষ কথা।
চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। আর বাসভবনে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে রাউজান উপজেলার গহিরায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেন। তখনকার চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ফজলে করিম চৌধুরীর বাড়ির আলমারিতে থাকা একটি পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল, একটি এলজি, একটি রিভলভার, একটি শটগান ও সাত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে শুধু রাইফেলের লাইসেন্স ছিল। বাকি অস্ত্র অবৈধ। সরকারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বৈধ অস্ত্র জমা না দেওয়ায় সেটিও অবৈধ হয়ে যায়।
অস্ত্র–গুলি উদ্ধারের ঘটনায় রাউজান থানায় মামলা হয়। ঐদিন এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর নগরের খুলশী এলাকার একটি ফ্ল্যাটেও অভিযান চালানো হয়েছে, কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি।
১২ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের আবদুল্লাহপুর এলাকা থেকে এ বি এম ফজলে করিমসহ তিনজনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ফজলে করিম আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে বিজিবি জানিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে ১০টি, এরপর আরো একাধিক মামলা হয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য নিরাপত্তার কারণে তাঁকে ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে আনা হয় হেলিকপ্টারে করে। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ফজলে করিমকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়।
রাউজানে মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটির ইবাদতখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের দুই মামলা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের ঘটনায় পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানার দুই মামলা এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সম্পাদক নুরুল আলম হত্যার ঘটনায় চকবাজার থানার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
পরে ফজলে করিমকে প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন ডিম ছুড়ে মারেন। এ সময় তাঁর ফাঁসির দাবিতে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন। রাউজান থানার এক মামলায় ফজলে করিমকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
ফজলে করিমের ফাঁসির দাবিতে রাউজান চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার মানববন্ধন বিক্ষোভও হয়েছে একাধিকবার। এই বাপ-বেটার অত্যাচারে চট্টগ্রাম ছাড়া হয়েছে বহু পরিবার, গুম-খুন হয়ে এখনো অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারকে পুঁজি করে রাউজানে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী নিজেকে বানিয়েছিলেন মস্ত বড় রাজা ও বিচারপতি: ফজলে করিম প্রকাশ জুনু করিমের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতেন রাউজানের অপরাধের সবকিছু। প্রশাসনের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে।
ভিন্নমতের হাজারো মানুষ হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিকার হয়েছেন গুম-খুনের। দখল-বেদখল ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। বছরের পর বছর এলাকাছাড়া ছিলেন বিএনপি, জামায়াত, মুনিরিয়া যুব তবলিগসহ অঙ্গসংগঠনগুলো। এমনকি ভিন্নমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের লোকজনও এলাকাছাড়া হয়েছেন।
কোনো অপরাধেরই বিচার হতো না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ধর্মীয় সংগঠন মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটির নেতাকর্মী-সমর্থকরা সবচেয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ সংস্থার অফিস, কর্মীদের ঘরবাড়িতে দিনের পর দিন হামলা-ভাঙচুর হলেও দেখতে ছাড়া কিছুই করার ছিল না। তবে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ফজলে করিম এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলে রাউজানের সাধারণ মানুষ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তারা এখন ফজলে করিমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রহর গুনছেন।